সুরের জগতের এক উজ্জল নক্ষত্র প্রয়াত সংগীত পরিচালক “প্রনব ঘোষ” । মাহমুদ দীপক

    সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক, বাংলা গানের সুরের জগতের এক উজ্জল নক্ষত্র প্রনব ঘোষ । 

জন্মঃ ৩রা ফেব্রুয়ারী ১৯৫০ইং ও মৃত্যুঃ ১৭ই আগষ্ট ২০০৭ইং।
অনেক জনপ্রিয় গানের সৃষ্টি হয়েছে তার সুর সংগীতে ।
 প্রনব ঘোষের জনপ্রিয় গানগুলো এখনও স্রোতা হৃদয় স্পর্শ করে। 
আমি সব কিছু ছাড়তে পারি তোমাকে ছাড়তে পারব না... -------------------------------------অনেক বেদনাভরা আমার এ জীবন, আমি আর ব্যাথা পেতে চাই না। --------------------­------- 
এ মন আমার পাথর তো নয় সব ব্যাথা সয়ে যাবে নিরবে........এই গানগুলি তার অনবদ্য সৃষ্টি ।

পারিবারিক পরিচিতি : এমনই হাজার বহুল জনপ্রিয় সব গানের সুরকার প্রণব ঘোষ (খোকন) ১৯৫০ সালে যশোর শহরের মাইকপট্টি সংলগ্ন বাগমারা পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রফুল্ল ঘোষ ছিলেন একজন আইনজীবি এবং মাতা রত্না প্রভা ঘোষ ছিলেন গৃহিণী। ৪ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে প্রণব সবার ছোট। ৭০-এর দশকে তিনি বিয়ের সময় ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নতুন নাম হয় মোহাম্মদ সফি প্রণব। কিন্তু বাবা-মায়ের দেয়া প্রণব ঘোষ নামেই তিনি বহুল পরিচিত। অতি ঘনিষ্ঠজনরা ছাড়া মোহাম্মদ সফি নামটি কেউই জানতেন না। তাঁর আদি পৈত্রিক বাড়ী নড়াইলের কলাগাছিতে এবং নানা বাড়ী খুলনার বেলফুলিয়া গ্রামে।

শিক্ষাজীবন : প্রনবের লেখাপড়া শুরু হয় যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউট স্কুলে। এইচ. এস. সি এবং গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করেন যশোর সরকারী এম. এম. বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হতে। ছোট বেলা থেকেই তিনি যথেষ্ট মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করতেন। স্কুলে পড়াকালীন তিনি ভাল কবিতা আবৃত্তি ও গান করতেন। এসব প্রতিযোগীতায় তাঁর প্রথমস্থান নেয়ার সাধ্য কারো ছিলো না। স্কুলের দু’জন শিক্ষক রবিউল ইসলাম স্যার ও প্রবোধ স্যার এসব অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার ব্যাপারে প্রণবকে সবচেয়ে বেশী সহযোগিতা করতেন। 

বাল্যজীবন : ছেলেবেলা থেকেই বাড়ীতে গান বাজনার পরিবেশ ছিল। দক্ষিণ বঙ্গের বড় বড় শিল্পীদের নিয়ে বাড়ীতে জলসা হতো। যেহেতু সবার ছোট তাই জলসায় ঢুকতে পারতেন না। সন্ধ্যা বেলা বাড়ির সবাই একসঙ্গে ঠাকুর ঘরে বসে ধর্মীয় গান করতেন। তখন থেকেই সুরের প্রতি তাঁর প্রচন্ড আগ্রহ জন্মায়। যশোরে অবোলা কান্ত মজুমদারের একটি গানের প্রতিষ্ঠান ছিল ‘সাহিত্য সংঘ’। তৎকালীন যশোরের বিখ্যাত গায়ক অজিত মিত্র ছোট্ট প্রণব’কে কোলে করে নিয়ে যেতেন গান শেখাতে। ৫ম শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি নিজে নিজে গান শিখতে চেষ্টা করতেন। মাগুরা থেকে গানের শিক্ষক ধীরেণ বাবু এসে তাঁর ৫ বোন’কে এক সাথে গান শেখাতেন, তবে মা প্রণব’কে গান শেখাতে নারাজ। প্রণব মায়ের বাঁধা মানতেন না। লুকিয়ে লুকিয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে দুইতলা বাড়ীর ছাদের উপর একা একা সঙ্গীতচর্চা করতেন প্রনব। গানের নেশায় ধীরে ধীরে তাঁর লেখাপড়ায় অবনতি শুরু হলো। বড় ভাই’রা এজন্যে তাঁকে প্রায়ই শাসন করতেন। তাদের স্বপ্ন ছিল প্রণব একদিন লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হবে। কোন শাসনই যেন সঙ্গীত থেকে প্রণবকে দুরে সরাতে পারে না। 

সঙ্গীত জীবন : স্কুলজীবন পার করে প্রণব ভর্তি হলেন যশোর সরকারী এম. এম. কলেজে। কলেজে পড়াকালীন বিভিন্ন সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানে প্রণব গানের শিল্পী হিসাবে আমন্ত্রিত হতেন। সে সময় প্রণব গানের শিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে চলে যান। দেশ স্বাধীনের পর দেশে ফিরে এলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীণ বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক হিসাবে দেশ স্বাধীনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৯ সালে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে গেল। দেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়াসহ তিন মন্ত্রী মাগুরায় আসলেন। যশোরের ডিসি মাগুরাতে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে গানের শিল্পী হিসেবে প্রণব’কে পছন্দ করলেন। প্রণবের গান শুনে তৎকালিন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী বি. চৌধুরী খুশী হলেন। প্রণব তখন ফ্যামিলি প্লানিংএ চাকরি করতেন। প্রণব যেন ঢাকায় অবস্থান করে তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারেন এজন্য জনাব বি. চৌধুরী প্রণব’কে যশোর থেকে ঢাকাস্থ অফিসে বদলী করে নিয়ে আসলেন। ১৯৮১ সালে প্রণব প্রথম চলচ্চিত্রে গান করেন। আবদুল্লাহ আল মামুনের চিত্রনাট্যে ‘এখনই সময়’ ছবিতে শেখসাদী খানের সুরে ‘আমি রাজ্জাক হইলাম না, আমি কবরী হইলাম না, আল্লাহ কেন নায়ক কইরা জন্ম দিল না।’ গানটি প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সর্বমোট তিনি প্রায় ২০০ সিনেমার গানে সুর দিয়েছেন। সিনেমা হলে গিয়ে যখন ছবি দেখতেন তখন তিনি তাঁর নিজের গাওয়া গান নিজেই পছন্দ করতেন না। যেহেতু প্রণব ছোট বেলা থেকেই নিজে বিভিন্ন গানের নতুন নতুন সুর দেবার চেষ্টা করতেন, তাই এ সময় তিনি গান গাওয়া ছেড়ে সুরের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। উপ-মহাদেশের বিখ্যাত সুরকার দেবু ভট্টাচার্যের কাছে সুর তৈরীর কাজ শিখলেন। এরপর তিনি সেখসাদী খান ও সুবল দাসগুপ্ত-এর কাছে কাজ শিখলেন। সর্বশেষ তিনি প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজের কাছে কাজ শিখেছেন। এই কাজের ফাঁকে তিনি আবার চলচ্চিত্রেও গান করতেন এবং পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন। ক্যাসেট ইন্ডাট্রি তখন সবে মাত্র শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ক্যাসেট তেমন একটা শুনতেন না। চট্ট্রগ্রামের দেবু নামে এক বন্ধু প্রথম তাঁকে ক্যাসেট বের করার পরামর্শ দিলেন। ১২টি গানে সুর দিয়ে ক্যাসেট বের করাকে তিনি অসম্ভব মনে করলেন। এক রকম জোর করেই তাঁর বনধু প্রণব’কে ক্যাসেট জগতে প্রবেশ করালেন। এর পর তিনি আর থেমে থাকেননি। নব্বই দশকের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেন। আধুনিক গানের বিশাল বাজার তৈরী করলেন। নতুন শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন আলাদা এক জগৎ। প্রণবের জীবনের প্রথম ক্যাসেটের শিল্পী ছিলেন উমা খান, দ্বিতীয় ক্যাসেটের শিল্পী ছিলেন মুশরাত শবনব, তৃতীয় ক্যাসেটের শিল্পী শরীফ রানা এবং চতুর্থ ক্যাসেটের শিল্পী ছিলেন শুভ্র দেব। চতুর্থ ক্যাসেটির নাম ছিল ছোঁয়া। প্রথম তিনটি ক্যাসেট খুব একটা জনপ্রিয়তা না পেলেও শ্রভ্রদেবের গাওয়া গানের চতুর্থ ক্যাসেটটি সুপার হিট হয়ে গেল। তার পর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি। একের পর এক ক্যাসেট প্রকাশ করলেন। এসবের মাঝে তিনি আবার চলচ্চিত্রের গানেও সুরারোপ করতেন। কিন্তু ছবিতে নকল গানের প্রাধান্য থাকায় তিনি চলচ্চিত্র থেকে সরে আসলেন। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ২০টি সিনেমার গানে সুরারোপ করেছেন। দেশে এবং দেশের বাইরে অনেক শিল্পীকে দিয়ে তিনি গান করিয়েছেন। 
বাংলাদেশের সাউন্ডটেক থেকে ভারতের কুমার শানু’র কণ্ঠে যে গান গুলো মুক্তি পেয়েছে তাঁর মধ্যে অন্যতম 
(১) স্বজনী আমি তো তোমায় ভুলিনি’ 
(২) ‘শিল্পীর জন্যে গান, কবির জন্যে কবিতা’। 
রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহ্‌মতুল্লাহ, এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, বেবী নাজনীন, কনক চাঁপা, মমতাজ, খালিদ হাসান মিলু, আয়ুব বাচ্চু, হাসানসহ বাংলাদেশের সমস্ত শিল্পীই তাঁর সুরে গান গেয়েছেন। জনপ্রিয়তা পেয়েছে বহু গান। আধুনিক সঙ্গীতের অনেক শিল্পীই তাঁর সুরে গান গেয়ে আজ জনপ্রিয় এবং প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে অন্যতম, 

শুভ্রদেব, রবি চৌধুরী, ডলি সায়ন্তনি, এসডি রুবেল, আঁখি আলমগীরসহ আরও অনেকে। তবে তাঁর সুরে সবচেয়ে বেশী গান গেয়েছেন ডলি সায়ন্তনি, শুভ্রদেব, তপন চৌধুরী, এস. ডি. রুবেল, আঁখি আলমগীর। 
২০০৭ সাল পর্যন্ত তাঁর সুরে প্রায় ৪০০টি ক্যাসেট মুক্তি পেয়েছে। তাঁর এ্যালবামের সংখ্যা ৩০০এর অধিক যা এদেশের অডিও ইন্ডাষ্ট্রিতে সর্বাধিক। ৩০০০ থেকে ৩৫০০ গানে তিনি সুরারোপ করেছেন। বাংলা গানে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন ভিন্ন এক ধারা। 
তাঁর সুরে শেষ গানটি হচ্ছে ডিরেক্টর নার্গিস আক্তারের “মেঘের কোলে রোদ” ছায়াছবির। 
সঙ্গীতাংঙ্গনে চির অমর হয়ে থাকবেন প্রয়াত সুরশ্রষ্টা প্রনব ঘোষ...... বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের অমর এই মানুষটির কথা আমরা কি মনে করি..... ? 
যিনি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন কয়েক বছর আগে । নব্বই দশকের সঙ্গীতাংঙ্গনের প্রায় ৯০ভাগ শিল্পীর অন্তরে যিনি এখনো আঘাত করেন । হাজার ক্যাসেটের জনক এই দেশ বরেন্য সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক প্রনব ঘোষ আমাদের বাংলাদেশে তার প্রিয় জন্ম স্থান যশোরের মাটিতেই শুয়ে আছেন । 
যার অবদানে আজকে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন যেসব সঙ্গীত শিল্পীরা তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন.........। 

তপন চৌধুরী - অনুশোচনা 
শুভ্র দেব - বুকের জমিন 
ডলি সায়ন্তনী - কালিয়া 
আঁখি আলমগীর - 
ঝুমু খান - 
রবি চৌধুরী - পাশাপাশি 
আলম আরা মিনু - রাজপ্রাষাদ 
এস ডি রুবেল - শুধু একবার 
বাদশা বুলবুল - হ্নদয়ের কবিতা 
খালিদ হাসান মিলু - শেষ ভালবাসা 
সোহেল মেহেদী - বুকের ভিতর কষ্ট 
পলাশ, রবি চৌধুরী, সাজু, চন্দন সিনহা, মহসিন খান, মনি কিশোর.... সহ দেশ ও দেশের বাইরে অনেক গুনী শিল্পী। তিনি আর কেউ নয় তিনি একজনই সুরশ্রষ্টা জননন্দিত প্রনব ঘোষ অমর হয়ে আছেন তার সুরের মাঝে.................।
দর্শক চলুন এবার আমরা প্রনব ঘোষের জীবনের কিছু স্বরনীয় মুহুর্ত দেখে আসি।

A Tribute To BD Celebrity Music Director Pranab Ghosh.


#pranabghosh #tribute #music

0 মন্তব্যসমূহ